অধ্যাপক আবুল বারকাত
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা উগ্র রূপ ধারণ করেছে। এ সাম্প্রদায়িকতা অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ উভয় শক্তির (উপাদানের) মাধ্যমে ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতা-ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’কে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রয়োগ করে সুসংগঠিত সশস্ত্র জঙ্গী কর্মকা-ের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে উদ্যত। তারা সৃষ্টি করেছে মূল ধারার রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র, মূল ধারার সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার, মূল ধারার অর্থনীতির মধ্যে আরেকটি অর্থনীতি। ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের এ কৌশল আসলে ধর্মের ‘সুঃযড়ং’-এর সাথে বাস্তবের ‘ষড়মড়ং’-এর সম্মিলন-উদ্ভূত এক দর্শন, যা ধর্মকে রাজনৈতিক মতাদর্শে রূপান্তরিত করে; আর ধর্ম-ভিত্তিক এ রাজনৈতিক মতাদর্শ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। ঐতিহাসিকভাবে পূর্ববাংলায় ইসলাম ধর্ম যখন উদারনৈতিক ও মানবিক প্রকৃতির তখন সমসাময়িককালে এদেশের অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতিতে এমন কি পরিবর্তন ঘটেছে যার ফলে এখানে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা এমন জঙ্গী রূপ নিচ্ছে জোরদখল করতে চায় সবকিছু। কি সেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি যার ওপর ভর করে ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িকতা পুষ্ট হচ্ছে? তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত কত শক্ত, কত সুদৃঢ়? উগ্র সাম্প্রদায়িকতা কতদূর বিস্তৃত হবার ক্ষমতা রাখে পারবে কি তা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে? সর্বশেষ দৃশ্যমান ১৭ আগস্ট ২০০৫-এ “গায়ের জোরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরে” বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টি আর নেহায়েত ‘সমস্যা’ পর্যায়ে নেই, তা উত্তরিত হয়েছে ‘সঙ্কটে।’ গুণগত দিক থেকে সাম্প্রদায়িকতার উত্থানে এ এক নতুন পর্যায়। আর ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানকে আরও এক ধাপ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে সাম্প্রদায়িকতার অনগ্রসর-পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গি দেশকে হাজার বছর পিছিয়ে দিতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা যুক্তির ধার ধারে না, অন্ধকারই তার যুক্তি-ভিত্তি। আর তাই দেশ বাঁচাতে সাম্প্রদায়িকতার গতি রোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ১৯৭২-এর মূল সংবিধানের চেতনায় জনকল্যাণকামী এক সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ এ দেশের জনগণের সুদৃঢ় ঐক্যের আর কোন বিকল্প নেই। সৃজনশীল এ কর্মযজ্ঞে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও কালক্ষেপণ মহাবিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি আসলে কি কিছু যোগসূত্র
মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি প্রপঞ্চটি তুলনামূলক এক নতুন ধারণা। মৌলবাদের অর্থনীতি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এক ঘনীভূত প্রকাশ (পড়হপবহঃৎধঃবফ বীঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ ৎবষরমরড়ঁং পড়সসঁহধষ ঢ়ড়ষরঃরপং)। মৌলবাদের অর্থনীতি অসাম্প্রদায়িক চেতনাবিরুদ্ধ। এক কথায় এ অর্থনীতি আমাদের মুক্তি-স্বাধীনতা উদ্ভূত ৭২’এর সংবিধানের মূল চেতনা বিরুদ্ধ। জনকল্যাণমুখী বিকাশ-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এবং অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক মানস কাঠামো সৃষ্টির ব্যর্থতা থেকেই পুষ্ট মৌলবাদ ও তার অর্থনীতি। এ ব্যর্থতাই মৌলবাদের অর্থনীতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এ ব্যর্থতাই ধর্মের নামে জোর জবরদস্তি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে উদ্যত জঙ্গীবাদের সীমাহীন জঙ্গিত্বের প্রধান কারণ। যে জঙ্গিত্বের নৃশংস-অসভ্য বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখলাম ২০০৫-এ।
মৌলবাদের মর্মকথা
ধর্মীয় মৌলবাদ হচ্ছে যুদ্ধংদেহী এক ধর্মপ্রীতি। এটা এমনই এক বিশ্বাস যা প্রতিনিয়ত আদর্শিক সংঘর্ষের জন্য তৈরি থাকার প্রেরণা যোগায়। বড় ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে এর অস্তিত্ব সুস্পষ্ট। খ্রিস্ট ধর্ম, ইসলাম, ইহুদী, হিন্দু, বৌদ্ধ এমনকি কনফুসিয়াস অনুসারীদের কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। খ্রিস্ট ধর্মের ক্ষেত্রে মতাদর্শের প্রভাব যতটা প্রবল ইসলাম বা ইহুদীর বেলায় ততটা জোরালো নয়। সব ধর্মের মৌলবাদীরা নির্দিষ্ট এক ছকের অনুসারী। তারা আধ্যাত্মিকভাবে সংগ্রামের চেতনায় সদা প্রস্তুত। তাই ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসীদের সাথে মৌলবাদের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। মৌলবাদীরা তাদের আদর্শগত এই সংগ্রাম/সংঘর্ষকে প্রচলিত রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে মূল্যায়ন করে না। বরং তাদের বিশ্বাস, এ যুদ্ধ হচ্ছে শুভ এবং অশুভ শক্তির মধ্যে দুনিয়াব্যাপী লড়াই। অস্তিত্ব হারানোর প্রচ্ছন্ন এক ভীতি মৌলবাদীদের প্রতিনিয়ত তাড়িত করে। এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রায়শ তারা সমাজের মূলধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেরা বিকল্প এক চেতনার উদ্ভব ঘটায়। মনোনিবেশ করে আধুনিক যুক্তিগ্রাহ্যতার দিকে। তথাপি মৌলবাদীরা অবাস্তব কোনো ধ্যান ধারণার অনুসারী না। তারা তাদের মূল আদর্শকে অনন্য সাধারণ গুণসম্পন্ন নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নতুন মতাদর্শের সূচনা করে। তারা মৌলবাদী আদর্শে বিশ্বাসীদের জন্য মেলে ধরে কর্মপরিকল্পনা। মৌলবাদীরা তাদের ধর্মীয় পৌরাণিক কাহিনীকে সৃষ্টিকর্তার কর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সদা সচেষ্ট। এ উদ্দেশ্যে তারা জটিল সব পৌরাণিক কাহিনীকে সর্বজন উপযোগী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আর এসব মতাদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হলে তাদের মধ্যে তৈরি হয় ক্ষোভ। তারা হয়ে ওঠে প্রতিহিংসাপরায়ণ।
উৎস : ইধৎশধঃ অ (২০০৬) “ঊপড়হড়সরপং ড়ভ ঋঁহফধসবহঃধষরংস ধহফ ঃযব এৎড়ঃিয ড়ভ চড়ষরঃরপধষ ওংষধস রহ ইধহমষধফবংয” রহ ঝড়পরধষ ঝপরবহপব জবারব,ি ঞযব উযধশধ টহরাবৎংরঃু
ঝঃঁফরবং, ঠড়ষ-২৩, ঘড়-২, উবপ. ২০০৬.
গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে সমাজতন্ত্রের উত্থান আর শেষের দিকে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে ভাঙ্গন-পরিবর্তন, উন্নত পুঁজিবাদী দেশসমূহে অর্থনৈতিক সঙ্কট, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী মনোভাবের স্পষ্ট প্রকাশ, পৃথিবীর এক মেরুয়ায়ন আর বিশ্বায়নের ডামাডোল ধর্মভিত্তিক মৌলবাদের উত্থানে গতি বৃদ্ধি করেছে। সাম্রাজ্যবাদ মৌলবাদের উত্থান ত্বরান্বয়নে কোথাও প্রধান ভূমিকা পালন করেছে (তালেবানইজম, মোল্লা ওমর, বিন লাদেন কাদের সৃষ্টি?), আবার কোথাও স্বার্থ উদ্ধারের পরে তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসবই শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হয় মুনাফা সমীকরণ দিয়ে। সাম্রাজ্যবাদ কখন কোথায় কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে তা নির্ভর করছে তার নিজস্ব রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমীকরণে স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার ওপরÑযেখানে শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্বার্থটিই প্রধান। কারণ ৩০০% মুনাফা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকলে ফাঁসির সম্ভাবনা জেনেও এমন কোনো অপরাধ নেই যার ঝুঁকি পুঁজি নেবে না। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের সাথে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক-অর্থনীতির উত্থান ও বিকাশ যেমন সাযুজ্যপূর্ণ তেমনি সাম্রাজ্যবাদের অধিকতর বিকাশের স্বার্থে সুনির্দিষ্ট ধরনের মৌলবাদ বাধার কারণ হলে তা প্রতিস্থাপিত হবে অন্য রূপের সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে এটাও লক্ষণীয়। তেল-গ্যাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি, পানি সম্পদের ভৌগোলিক অর্থনীতি, বিশ্ব বাজারে (তথাকথিত ‘অবাধ বাজার’ আর বিশ্বায়নের নামে) কর্তৃত্ব স্থাপনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বর্তমান যুগে এসবই মৌলবাদের সাথে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার অন্যতম অনুষঙ্গ। বহিঃস্থ ও অভ্যন্তরীণ উভয় উপাদানই ধর্মের উদারনৈতিকতার বিপরীতে সঙ্কীর্ণতা বিকাশে ভূমিকা রাখে। একদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী ডলার অর্থনীতির বিপর্যয়, বিশ্ববাজারে পেট্রোডলারের বাড়-বাড়ন্ত ও অস্থিরতা, সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণ, ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ার ভেঙ্গে ফেলা এবং পরবর্তীতে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে সাম্রাজ্যবাদের অযৌক্তিক অতি-প্রতিক্রিয়া, ‘উন্নত’ বিশ্বে মুসলমান নামধারীদের প্রতি প্রকাশ্য সন্দেহ-অবিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলভা-ার সমৃদ্ধ দেশ ইরাক আক্রমণ ও দখল, গোলাকায়নের গোলকধাঁধায় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অপসংস্কৃতি প্রচার, আর অন্যদিকে আমাদের দেশে দুর্বৃত্তায়িত আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা-বঞ্চনা-বিপন্নতা বৃদ্ধি ও দৈনন্দিন জীবনে মানুষের ক্রমবর্ধমান অসহায়ত্বএসব কিছুই ধর্মের উদার ধ্যান-ধারণার বিপরীতে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় অবদান রাখছে। এসব সুযোগ ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাহিদা বৃদ্ধিতে সহায়ক, আর সে চাহিদা পূরণেই মৌলবাদী অর্থনীতির উদ্ভব বলা যায়। এ দু’টি একে অন্যের পরিপূরকÑযৌথভাবে তাদের মূল লক্ষ্য ‘ধর্মের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল’।
পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের উদ্ভবÑঐতিহাসিকভাবে উদারনৈতিক-মানবিক
পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি-ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকরা যা কিছু লিখেছেন তার অধিকাংশই অসম্পূর্ণ এবং নয় তা যথেষ্ট তথ্যভিত্তিক। ভূগোল, নদীর প্রবাহ পরিবর্তন, কৃষি সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ, ভূমি খাজনার গতি প্রকৃতি, ঘটনাপঞ্জির কালানুক্রমিক গ্রন্থনা, হিন্দু রাজা ও মুসলমান সম্রাটদের রাজ্যনীতিÑপূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ ইতিহাস রচনায় এসব তথ্যের নির্মোহ বিশ্লেষণ নেই বললেই চলে। সংশ্লিষ্ট ইতিহাস রচনার তত্ত্ব এদিক থেকে যথেষ্ট দুর্বল।
পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ ইতিহাসে মূলত চার ধারার বক্তব্য পাওয়া যায় : অভিবাসন (রসসরমৎধঃরড়হ), তরবারি (ংড়িৎফ), পৃষ্ঠপোষকতা (ঢ়ধঃৎড়হধমব), ও সামাজিক ম্ুিক্ত (ংড়পরধষ ষরনবৎধঃরড়হ)। ইতোমধ্যে উল্লিখিত কারণে এসবের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ নয় : অভিবাসিত কারা, কখন-কোন সময়ে-কি কারণে অভিবাসন হলো (?); তরবারির শক্তি কখন কোথায় এ দেশে ইসলামকে গণধর্মে (সধংং ৎবষরমরড়হ) রূপান্তর ঘটাল (?); এমনকি সবচেয়ে বেশি রক্ষণশীল মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবও জোরজবরদস্তি উৎসাহ দেননি (আকবর বৈষম্যমূলক খাজনা বন্ধ করেছিলেন; হিন্দু ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন) ইত্যাদি। (চলবে)
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;
সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা উগ্র রূপ ধারণ করেছে। এ সাম্প্রদায়িকতা অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ উভয় শক্তির (উপাদানের) মাধ্যমে ‘অর্থনৈতিক ক্ষমতা-ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া’কে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রয়োগ করে সুসংগঠিত সশস্ত্র জঙ্গী কর্মকা-ের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে উদ্যত। তারা সৃষ্টি করেছে মূল ধারার রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র, মূল ধারার সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার, মূল ধারার অর্থনীতির মধ্যে আরেকটি অর্থনীতি। ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের এ কৌশল আসলে ধর্মের ‘সুঃযড়ং’-এর সাথে বাস্তবের ‘ষড়মড়ং’-এর সম্মিলন-উদ্ভূত এক দর্শন, যা ধর্মকে রাজনৈতিক মতাদর্শে রূপান্তরিত করে; আর ধর্ম-ভিত্তিক এ রাজনৈতিক মতাদর্শ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। ঐতিহাসিকভাবে পূর্ববাংলায় ইসলাম ধর্ম যখন উদারনৈতিক ও মানবিক প্রকৃতির তখন সমসাময়িককালে এদেশের অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি-রাষ্ট্রনীতিতে এমন কি পরিবর্তন ঘটেছে যার ফলে এখানে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা এমন জঙ্গী রূপ নিচ্ছে জোরদখল করতে চায় সবকিছু। কি সেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি যার ওপর ভর করে ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িকতা পুষ্ট হচ্ছে? তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত কত শক্ত, কত সুদৃঢ়? উগ্র সাম্প্রদায়িকতা কতদূর বিস্তৃত হবার ক্ষমতা রাখে পারবে কি তা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে? সর্বশেষ দৃশ্যমান ১৭ আগস্ট ২০০৫-এ “গায়ের জোরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরে” বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টি আর নেহায়েত ‘সমস্যা’ পর্যায়ে নেই, তা উত্তরিত হয়েছে ‘সঙ্কটে।’ গুণগত দিক থেকে সাম্প্রদায়িকতার উত্থানে এ এক নতুন পর্যায়। আর ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানকে আরও এক ধাপ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে সাম্প্রদায়িকতার অনগ্রসর-পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গি দেশকে হাজার বছর পিছিয়ে দিতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা যুক্তির ধার ধারে না, অন্ধকারই তার যুক্তি-ভিত্তি। আর তাই দেশ বাঁচাতে সাম্প্রদায়িকতার গতি রোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ১৯৭২-এর মূল সংবিধানের চেতনায় জনকল্যাণকামী এক সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ এ দেশের জনগণের সুদৃঢ় ঐক্যের আর কোন বিকল্প নেই। সৃজনশীল এ কর্মযজ্ঞে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও কালক্ষেপণ মহাবিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি আসলে কি কিছু যোগসূত্র
মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি প্রপঞ্চটি তুলনামূলক এক নতুন ধারণা। মৌলবাদের অর্থনীতি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এক ঘনীভূত প্রকাশ (পড়হপবহঃৎধঃবফ বীঢ়ৎবংংরড়হ ড়ভ ৎবষরমরড়ঁং পড়সসঁহধষ ঢ়ড়ষরঃরপং)। মৌলবাদের অর্থনীতি অসাম্প্রদায়িক চেতনাবিরুদ্ধ। এক কথায় এ অর্থনীতি আমাদের মুক্তি-স্বাধীনতা উদ্ভূত ৭২’এর সংবিধানের মূল চেতনা বিরুদ্ধ। জনকল্যাণমুখী বিকাশ-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এবং অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক মানস কাঠামো সৃষ্টির ব্যর্থতা থেকেই পুষ্ট মৌলবাদ ও তার অর্থনীতি। এ ব্যর্থতাই মৌলবাদের অর্থনীতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এ ব্যর্থতাই ধর্মের নামে জোর জবরদস্তি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে উদ্যত জঙ্গীবাদের সীমাহীন জঙ্গিত্বের প্রধান কারণ। যে জঙ্গিত্বের নৃশংস-অসভ্য বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখলাম ২০০৫-এ।
মৌলবাদের মর্মকথা
ধর্মীয় মৌলবাদ হচ্ছে যুদ্ধংদেহী এক ধর্মপ্রীতি। এটা এমনই এক বিশ্বাস যা প্রতিনিয়ত আদর্শিক সংঘর্ষের জন্য তৈরি থাকার প্রেরণা যোগায়। বড় ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে এর অস্তিত্ব সুস্পষ্ট। খ্রিস্ট ধর্ম, ইসলাম, ইহুদী, হিন্দু, বৌদ্ধ এমনকি কনফুসিয়াস অনুসারীদের কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। খ্রিস্ট ধর্মের ক্ষেত্রে মতাদর্শের প্রভাব যতটা প্রবল ইসলাম বা ইহুদীর বেলায় ততটা জোরালো নয়। সব ধর্মের মৌলবাদীরা নির্দিষ্ট এক ছকের অনুসারী। তারা আধ্যাত্মিকভাবে সংগ্রামের চেতনায় সদা প্রস্তুত। তাই ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসীদের সাথে মৌলবাদের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। মৌলবাদীরা তাদের আদর্শগত এই সংগ্রাম/সংঘর্ষকে প্রচলিত রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে মূল্যায়ন করে না। বরং তাদের বিশ্বাস, এ যুদ্ধ হচ্ছে শুভ এবং অশুভ শক্তির মধ্যে দুনিয়াব্যাপী লড়াই। অস্তিত্ব হারানোর প্রচ্ছন্ন এক ভীতি মৌলবাদীদের প্রতিনিয়ত তাড়িত করে। এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রায়শ তারা সমাজের মূলধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেরা বিকল্প এক চেতনার উদ্ভব ঘটায়। মনোনিবেশ করে আধুনিক যুক্তিগ্রাহ্যতার দিকে। তথাপি মৌলবাদীরা অবাস্তব কোনো ধ্যান ধারণার অনুসারী না। তারা তাদের মূল আদর্শকে অনন্য সাধারণ গুণসম্পন্ন নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নতুন মতাদর্শের সূচনা করে। তারা মৌলবাদী আদর্শে বিশ্বাসীদের জন্য মেলে ধরে কর্মপরিকল্পনা। মৌলবাদীরা তাদের ধর্মীয় পৌরাণিক কাহিনীকে সৃষ্টিকর্তার কর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সদা সচেষ্ট। এ উদ্দেশ্যে তারা জটিল সব পৌরাণিক কাহিনীকে সর্বজন উপযোগী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আর এসব মতাদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হলে তাদের মধ্যে তৈরি হয় ক্ষোভ। তারা হয়ে ওঠে প্রতিহিংসাপরায়ণ।
উৎস : ইধৎশধঃ অ (২০০৬) “ঊপড়হড়সরপং ড়ভ ঋঁহফধসবহঃধষরংস ধহফ ঃযব এৎড়ঃিয ড়ভ চড়ষরঃরপধষ ওংষধস রহ ইধহমষধফবংয” রহ ঝড়পরধষ ঝপরবহপব জবারব,ি ঞযব উযধশধ টহরাবৎংরঃু
ঝঃঁফরবং, ঠড়ষ-২৩, ঘড়-২, উবপ. ২০০৬.
গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে সমাজতন্ত্রের উত্থান আর শেষের দিকে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে ভাঙ্গন-পরিবর্তন, উন্নত পুঁজিবাদী দেশসমূহে অর্থনৈতিক সঙ্কট, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী মনোভাবের স্পষ্ট প্রকাশ, পৃথিবীর এক মেরুয়ায়ন আর বিশ্বায়নের ডামাডোল ধর্মভিত্তিক মৌলবাদের উত্থানে গতি বৃদ্ধি করেছে। সাম্রাজ্যবাদ মৌলবাদের উত্থান ত্বরান্বয়নে কোথাও প্রধান ভূমিকা পালন করেছে (তালেবানইজম, মোল্লা ওমর, বিন লাদেন কাদের সৃষ্টি?), আবার কোথাও স্বার্থ উদ্ধারের পরে তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসবই শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হয় মুনাফা সমীকরণ দিয়ে। সাম্রাজ্যবাদ কখন কোথায় কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে তা নির্ভর করছে তার নিজস্ব রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমীকরণে স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার ওপরÑযেখানে শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্বার্থটিই প্রধান। কারণ ৩০০% মুনাফা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকলে ফাঁসির সম্ভাবনা জেনেও এমন কোনো অপরাধ নেই যার ঝুঁকি পুঁজি নেবে না। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের সাথে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক-অর্থনীতির উত্থান ও বিকাশ যেমন সাযুজ্যপূর্ণ তেমনি সাম্রাজ্যবাদের অধিকতর বিকাশের স্বার্থে সুনির্দিষ্ট ধরনের মৌলবাদ বাধার কারণ হলে তা প্রতিস্থাপিত হবে অন্য রূপের সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে এটাও লক্ষণীয়। তেল-গ্যাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি, পানি সম্পদের ভৌগোলিক অর্থনীতি, বিশ্ব বাজারে (তথাকথিত ‘অবাধ বাজার’ আর বিশ্বায়নের নামে) কর্তৃত্ব স্থাপনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বর্তমান যুগে এসবই মৌলবাদের সাথে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার অন্যতম অনুষঙ্গ। বহিঃস্থ ও অভ্যন্তরীণ উভয় উপাদানই ধর্মের উদারনৈতিকতার বিপরীতে সঙ্কীর্ণতা বিকাশে ভূমিকা রাখে। একদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী ডলার অর্থনীতির বিপর্যয়, বিশ্ববাজারে পেট্রোডলারের বাড়-বাড়ন্ত ও অস্থিরতা, সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণ, ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ার ভেঙ্গে ফেলা এবং পরবর্তীতে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে সাম্রাজ্যবাদের অযৌক্তিক অতি-প্রতিক্রিয়া, ‘উন্নত’ বিশ্বে মুসলমান নামধারীদের প্রতি প্রকাশ্য সন্দেহ-অবিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলভা-ার সমৃদ্ধ দেশ ইরাক আক্রমণ ও দখল, গোলাকায়নের গোলকধাঁধায় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অপসংস্কৃতি প্রচার, আর অন্যদিকে আমাদের দেশে দুর্বৃত্তায়িত আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা-বঞ্চনা-বিপন্নতা বৃদ্ধি ও দৈনন্দিন জীবনে মানুষের ক্রমবর্ধমান অসহায়ত্বএসব কিছুই ধর্মের উদার ধ্যান-ধারণার বিপরীতে সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় অবদান রাখছে। এসব সুযোগ ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাহিদা বৃদ্ধিতে সহায়ক, আর সে চাহিদা পূরণেই মৌলবাদী অর্থনীতির উদ্ভব বলা যায়। এ দু’টি একে অন্যের পরিপূরকÑযৌথভাবে তাদের মূল লক্ষ্য ‘ধর্মের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল’।
পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের উদ্ভবÑঐতিহাসিকভাবে উদারনৈতিক-মানবিক
পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি-ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকরা যা কিছু লিখেছেন তার অধিকাংশই অসম্পূর্ণ এবং নয় তা যথেষ্ট তথ্যভিত্তিক। ভূগোল, নদীর প্রবাহ পরিবর্তন, কৃষি সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ, ভূমি খাজনার গতি প্রকৃতি, ঘটনাপঞ্জির কালানুক্রমিক গ্রন্থনা, হিন্দু রাজা ও মুসলমান সম্রাটদের রাজ্যনীতিÑপূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ ইতিহাস রচনায় এসব তথ্যের নির্মোহ বিশ্লেষণ নেই বললেই চলে। সংশ্লিষ্ট ইতিহাস রচনার তত্ত্ব এদিক থেকে যথেষ্ট দুর্বল।
পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ ইতিহাসে মূলত চার ধারার বক্তব্য পাওয়া যায় : অভিবাসন (রসসরমৎধঃরড়হ), তরবারি (ংড়িৎফ), পৃষ্ঠপোষকতা (ঢ়ধঃৎড়হধমব), ও সামাজিক ম্ুিক্ত (ংড়পরধষ ষরনবৎধঃরড়হ)। ইতোমধ্যে উল্লিখিত কারণে এসবের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ নয় : অভিবাসিত কারা, কখন-কোন সময়ে-কি কারণে অভিবাসন হলো (?); তরবারির শক্তি কখন কোথায় এ দেশে ইসলামকে গণধর্মে (সধংং ৎবষরমরড়হ) রূপান্তর ঘটাল (?); এমনকি সবচেয়ে বেশি রক্ষণশীল মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবও জোরজবরদস্তি উৎসাহ দেননি (আকবর বৈষম্যমূলক খাজনা বন্ধ করেছিলেন; হিন্দু ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন) ইত্যাদি। (চলবে)
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;
সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি